সিরিজঃ সাইকেল
সম্পাদনাঃ শোভন সেনগুপ্ত
সাইকেলের সাথে প্রথম পরিচয় হয় আমার চার বছর বয়সে। তখন বাবার সাইকেলে চেপে বেড়াতে যেতাম। সাইকেলের রডের সাথে আমার জন্য ছোট একটা সিট বসানো ছিল। যাতে আমি আরাম বসতে পারি ।সে সময় সাইকেলের ক্রিং ক্রিং আওয়াজটা ভাল লাগলো অপ্রয়োজনেও বাজাতাম। বাবা যখন থকতো না সাইকেলটাকে টেনে নিয়ে যাঔয়ার চেষ্টা করতাম। মাঝে মাঝে ফেলেও দিয়েছি। ক্লাস ওয়ান টু এভাবে পার করে দিলাম। সাইকলের সাথে সখ্যতাও বাড়লো।ক্লাস থ্রীতে এসে হাফ প্যাডেল চালানো শিখে গেলাম মানে হচ্ছে ডান হাত সিটে পা দুটো দুই প্যাডেলে আর বাহাত বাম হাতলে। সেই প্রথম প্যাডেল মারা। বাবা শুনে খুশি হয়েছিলেন যে আমি সাইকেল চালানো শিখেছি।
ক্লাস ফোরে উঠতেই সাইকেল চালানোর আর এক ধাপ এগিয়ে নিলাম। হাফ প্যাডেল থেকে সাইকেলের রডে বসে চালাচ্ছি। এটার জন্য এক পরিচিত মানুষের সাইকেল নিতে হয়েছিল। আর শিখে বাড়ি ফিরছিলাম মোড় নিতেই ঘটল বিপত্তি ! আমি সাইকেল থেকে পাশের গর্তে পড়ে গেলাম। আমার পা থেকে রক্ত ঝরছিলো আর চামড়া অনেকখানি কেটে গেছিলো। আমার চিৎকারে আমায় উদ্ধার করতে প্রথমে মা আসে তারপর বাবা এসছিলো। টেনে তুললো বাড়িতে প্রাথমিক চিকিৎসা দিলো। তারপর দুজনেই প্রচন্ড বকলো সেইসময়। এই ঘটনার কিছুদিন স্কুলের হাজিরা খাতায় অনুপস্থিত ছিলাম কারণ আমি হাঁটতে পারিনি ভাল করে সেসময়। আর আমাকে হেঁটে স্কুলে যেতে হত। বাবা যদিও মাঝে মাঝে পৌঁছে দিতেন। ক্ষতটার ব্যাথাকমে ও শুকনো হবার পর আবার সাইকেল চালাতে শুরু করি। অনেকে এখনো দাগটা দেখলে বলে কি হয়েছিল? সেদিনের কথাগুলো বলি অকপটে সকলকে।
পুরোপুরি সাইকেলের সিটে বসে চালানো শিখতে লাগলো আরো একবছর । তখন নিজের একটা সাইকেল হয়নি। ক্লাস ফাইভে উঠলাম নতুন স্কুল টিউশন। বাবা সাইকেল কিনে দিলেন। আমি যাতে ভালো মতো স্কুল যেতে পারি। খুব ভাল লেগেছিলো আমার একটা সাইকেল হবে! আর সাইকেল চালানো শিখলেও দূরের পথ পারি দেয়া হয়ে ওঠেনি। বাড়ি থেকে বেশি দূরে যেতে দিতনা। টিউশন পড়তে যেতে হে তিন কিমি দূরে স্যার এর বাড়িতে। বাবা ভরসা পেলেন না যে যেতে পারবো কিনা অতদূর। প্রথমদিন আমার পিছু পিছু এলেন। কিন্তু স্যার এর বাড়ি পৌঁছনোর আগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পরে যাই পাশের ভূট্টা ক্ষেতে। পাশে ছিল নাহলে এবারেও উঠার ক্ষমতা ছিলনা। সেবার আর রক্তপাত হয়নি ধুলো লেগেছিলো।
এর পর শুরু হল দুজনকে নিয়ে চালাতে পারি কিনা সেই পরীক্ষা । রোজ বাড়ির উঠোধে চালাতে চালাতে এটাও আয়ত্ব করে নিলাম। এবার ভাইকে স্কুলে দিয়ে আসতে পারবো আমিও। একদিন বন্ধুকে পেছনে বসিয়ে স্যার টিউশন বাড়ি ফিরছিলাম। রাস্তায়পথ অবরোধ করে বসে ছিল একটা বলদ। ভয় ও পাচ্ছিলাম পাশে কাটিয়ে যেতে পারলাম ঠিক। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পরে গেলাম মাটিতে। আমার কিছু না হলেও সাইকেলের ভূগোল পাল্টে গেল। সেযাত্রায় হ্যান্ডেল টা বেঁকে গেল । আমার কি সাধ্য ছিল তাকে সাড়িয়ে তোলা । মেকানিকের কাছে যেতে হল। এরপর থেকে সাইকেল মেকানিকদের সাথে সম্পর্ক বাড়তে লাগলো। মাঝে মাঝে চাকায় হাওয়া ভরা নাট বল্টু টাইট দেয়া টুকটাক দুর্ঘটনা তো ঘটতই। যত্ন নিতাম অনেক ধূয়ে মুছে পরিষ্কার রাখা।
সাইকেলের কত কি যে পাল্টেছি সিট,বেল, টায়ার,টিউব,সিটকভার, স্পোক ব্রেক। ঠিক হয়ে যাবার পর যে অনুভূতি হত প্রকাশ করার মত না। আর হাত ছেড়ে দিয়ে চালানো শিখে গেছিলাম ততদিনে। ওটাই চেষ্টা করে খুব জোরে চালিয়ে বাড়ি ফিরতাম। এভাবে নিজের খেয়াল খুশিমতো চালাতাম সাইকেল। দেখতে দেখতে ক্লাস নাইনের গন্ডিও পেরিয়ে যাই। এর পাশাপাশি সাইকেলটা ছয়ট হয়ে গেছিলো আর চালাতে অসুবিধা হচ্ছিলো। সামনে মাধ্যমিক বাবাকে বললাম এই সাইকেলে আর চলছেনা। অনেক আবদারের পর কিনে দায়েছিলেন নতুন হিরো সাইকেল। নতুন সাইকেলটা আরো বন্ধু হয়ে গেল কারণ চালাতে বেশ মজা ছিল । হিউয়েন সাং হয়ে যেতাম পথ আবিষ্কার এর জন্য যেসকল রাস্তা দিয়ে কখনো চলাফেরা করিনি সেইসব দিয়ে বাড়ি ফেরার। মাঝেসাজে দেরি হত এর জন্য বকাঝকাও শুনতে হয়েছিলো অনেক। আর রাস্তার সাথে সাথে আরোহী পাল্টে যেত যে আমার সাইকেলে বাড়ি ফিরতো আমাকে পেছনে বসিয়ে নিয়ে যেতে হত। আর বন্ধাবীদের বেলায় আমি চালিয়ে নিয়ে আসতাম। একজনকে তার বাড়ির সামনে এনে ফেলে দিয়েছিলাম। এখনো মনে পড়লে হাসি পায়। বিব্রতকর অবস্থায় পড়তাম তখন সাইকেলের চেন বারবার পড়তো আর কালিমাখা হাত মোছার কিছু পেতাম না….
প্রত্যেক প্রজাতন্ত্র দিবস স্বাধীনতা দিবসে সাইকেলে পতাকাটা লাগাতাম। টেস্ট পরীক্ষা হয়ে যাবার পর পেলাম সবুজ সাথীর সাইকেল। সেবার আমি অনেককে সাইকেল তুলে দিয়েছি যেভাবে পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে পুরস্কার হাতে তুলে দেয় সেভাবেই। মাধ্যমিকটাও কেটে গেল।
একাদশ দ্বাদশে টিউশন লাগাতার ছিল বেড়ানো হয়নি সেভাবে আগের মতই চলছিলো সাইকেলের সাথে দিনকাল। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে উঠলাম। তবুও সাইকেল চালাই কারণ এখনো মোটরসাইকেলে চালানো শিখিনি। যদিও বন্ধুদর অনেকে শিখেছে। সময় হলে শিখে নেবো সেটাও।
পরিবেশ বান্ধব এই সাইকেল ই আমার ভ্রমণ এর প্রথম পছন্দ ।
আরও পড়ুন >> পাঠকের নোটবুকঃ অমৃতফল